শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৭:৫৩ অপরাহ্ন
আবদুল আজিজ:
কক্সবাজার উপকুলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল চাষে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। শৈবাল থেকে খাদ্যপণ্য, ঔষধিপণ্য, প্রসাধনী পণ্য, সার, বায়ো ফুয়েল ও পরিবেশ দূষণরোধক পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। লবণাক্ত, আধা লবণাক্ত পানির পরিবেশে এটি জন্মে এবং সহজে চাষাবাদ করা যায়। একারণে সামুদ্রিক শৈবাল বিভিন্নভাবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। শৈবাল উৎপাদন প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণের কাজে পুরুষ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী নিয়োজিত আছেন, যা তাদের পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছে।
২০১০সালে কক্সবাজারে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পরীক্ষামূলকভাবে দুই প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করার মাধ্যমে দেশে প্রথম এর চাষ শুরু হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সাল থেকে কক্সবাজারের উপকুলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ উৎপাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট শৈবাল চাষ প্রকল্প শুরু করে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সমন্বয়ে ও কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে এ প্রকল্প চলছে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যায়ে কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়া, রেজুখাল, চরপাড়া ও চোফলদন্ডী উপকুলীয় অঞ্চলে শৈবালের চাষ হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ খাতে জড়িয়ে পড়ছে প্রায় ৪ শতাধিক কৃষি পরিবার। এসব পরিবার গুলো শৈবাল চাষে সাশ্রয়ী মুল্যের পুষ্টিসমৃদ্ধ মানব ও পশুখাদ্য পোশাক শিল্প ও ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল সহ সরকারের সমুদ্র অর্থনীতি ব্লু ইকোনমিতে ভূমিকা রাখছে। একই সাথে আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছে।
কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া এলাকার শৈবাল চাষি সাইদুল আলম কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট থেকে আমি শৈবাল চাষে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রশিক্ষনের পর আমি শৈবাল চাষে উদ্ভোদ্ধ হয়ে শৈবাল চাষ শুরু করেন। বর্তমানে বাঁকখালী নদীর মোহনায় চরের পানিতে শৈবাল চাষ করে এখন অনেকটা স্বাবলম্বী। শৈবাল বিক্রি করে চলে আমার সংসার।
নাসিমা বেগম নামের আরেক শৈবাল চাষী কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণার পক্ষ থেকে বাঁশ, বেত, রশি ও ভাসমান প্লাষ্টিকের বয়া ব্যবহার করে শৈবাল উৎপাদন করি। প্রতি মৌসুমে ৮০ থেকে ১লাখ টাকার শৈবাল বিক্রি করি। চলতি বছরে পার্বত্য বান্দরবানের লামা, আলিকদম, থানচি ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। শুধু সাইদুল, নাসিমা নয়, তাদের মতো রোকেয়া বেগম, ফরিদা ইয়াসমিন, মোহাম্মদ হোসেন, আবুল কালাম, সাদেক হোসেন, হেলাল উদ্দিন সহ অনেকে শৈবাল চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজার অফিস প্রধান ও উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরফুদ্দিন ভূঁইয়া কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলার উপকুলীয় অঞ্চলের সাগরপাড়ের জলশয় গুলোতে শৈবালের উপর গবেষণার মাধ্যমে চাষ বাস্তবায়িত হচ্ছে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার সাথে সামুদ্রিক শৈবাল ওষুধ ও শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে ১০২ গ্রুপের ২১৫ প্রজাতির শৈবালের মধ্যে থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও তার নিকটতম অঞ্চল থেকে ১২টি প্রজাতি শৈবাল সংগ্রহ করা হয়। আবার এরমধ্যে ৮টি প্রজাতি থেকে ২টি প্রজাতির শৈবাল চাষ হচ্ছে আমাদের দেশে।
মোহাম্মদ শরফুদ্দিন ভূঁইয়া আরও বলেন, বর্তমানে শৈবাল থেকে স্যুপ, সবজী বার্গার, সিঙ্গারা, সমুচা, নুডুলস, সালাদ, চাটনী, পাকোড়া, নিমকি, চকলেট, জেলীসহ সাশ্রয়ী মুল্যের পুষ্টিসমৃদ্ধ মানব ও পশুখাদ্য পোশাক শিল্প ও ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল পন্য উৎপাদিত হচ্ছে। যা সরকারের সমুদ্র অর্থনীতির ব্লু ইকোনমিতে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: আককাস আলী কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, শৈবাল একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজী। কসমেটিক সহ শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানী করা যাবে। অনেক ল্যাবরেটরিতে ‘এগার’ কেরাবিনা প্রোডাক্ট যার কেজি ২০ হাজার টাকা মুল্যের পণ্য তৈরী সম্ভব। ল্যাবরেটরিতে বীজ উৎপাদন হচ্ছে যা কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মো: বখতিয়ার কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, জাপান, সাউথ কোরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন করে থাকে। সামুদ্রিক শৈবালের বিষয়ে আগে আমাদের অভিজ্ঞতা বা গবেষণা ছিল না। ২০১৬ সাল থেকে ১০টি প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালের উপর গবেষনা শুরু করি। গবেষণায় উৎপাদন, কৌশল, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্যবহারের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। বর্তমানে ১০টি প্রজাতির মধ্যে ২টি প্রজাতির চাষ করা হচ্ছে। এটি উন্নতমানের পুষ্টি এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
এদিকে, মঙ্গলবার (৯মার্চ) দিনব্যাপী রপ্তানীযোগ্য সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কক্সবাজারের শহরের নুনিয়াছড়া উপকূলে হাসান আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাষিদের নিয়ে এক প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মো: বখতিয়ার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: আককাস আলী, কক্সবাজার অফিস ইনচার্জ ও উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরফুদ্দিন ভূঁইয়া, পরিকল্পনা ও মুল্যায়ন বিভাগের সদস্য আব্দুছ ছালাম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কৃষি ও তথ্যকেন্দ্রের পরিচালক ড. কবির উদ্দিন আহমেদ, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ওমর ফারুক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: মোস্তাফিজুর রহমান সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কর্মশালায় সামুদ্রিক শৈবাল চাষের সম্ভাবনা, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, অর্থায়ন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের গবেষণা নীতি নির্ধারক অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের রপ্তানিকারক বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও কৃষকগণ তাদের মূল্যবান মতামত প্রদান করেন। উক্ত প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মাঠ দিবস অনুষ্ঠানে ৫০জন চাষী অংশ নেয়।
ভয়েস/আআ